নবীজীর (সা.) মা উম্মে আয়মান

প্রিয় নবীজি (সঃ) এর দুই মা ‘মা আমেনা’ এবং ‘দুধমাতা হালিমা’র কথা আমরা জানি! আমরা কি জানি! নবীজীর (সঃ) আরেক মা উম্মে আয়মান এর কাহিনী!!!

আমাদের নবী (স) এর পিতা আব্দুল্লাহ একদিন মক্কার বাজারে গিয়েছিলেন কিছু কেনা-কাটা করার জন্য ।

এক জায়গায় তিনি দেখলেন, এক লোক কিছু দাস-দাসী নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে।

আব্দুল্লাহ দেখলেন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, একটা ছোট নয় বছরের কালো আফ্রিকান আবিসিনিয়ার মেয়ে ।

মেয়েটাকে দেখে আব্দুল্লাহর অনেক মায়া হলো, একটু রুগ্ন হালকা-পাতলা কিন্তু কেমন মায়াবী ও অসহায় দৃষ্টি দিয়ে তাঁকিয়ে আছে ।

তিনি ভাবলেন ঘরে আমেনা একা থাকেন, মেয়েটা পাশে থাকলে তার একজন সঙ্গী হবে ।

এই ভেবে তিনি মেয়েটাকে কিনে নিলেন ।

মেয়েটিকে আব্দুল্লাহ ও আমেনা অনেক ভালোবাসতেন । স্নেহ করতেন । এবং তারা লক্ষ্য করলেন যে, তাদের সংসারে আগের চেয়েও বেশি রাহমাত ও বরকত চলে এসেছে ।

এই কারণে আব্দুল্লাহ ও আমেনা মেয়েটিকে আদর করে নাম দিলেন “বারাকাহ”।

এই কাহিনীটি সেই, বারাকার।

তারপর একদিন আব্দুল্লাহ, ব্যবসার কারণে সিরিয়া রওনা দিলেন ।

আমেনার সাথে সেটাই ছিল উনার শেষ বিদায় ।

উনার যাত্রার দুই এক দিন পর আমেনা একরাতে স্বপ্নে দেখলেন, আকাশের একটা তারা যেন খুব আলো করে তার কোলে এসে পড়লো ।

পরদিন ভোরে তিনি বারাকাকে এই স্বপ্নের কথা বললেন ।

উত্তরে বারাকা মৃদু হেসে বললেন, “আমার মন বলছে আপনার একটা সুন্দর সন্তানের জন্ম হবে”।

আমেনা তখনও জানতেন না তিনি গর্ভ ধারণ করেছেন কিন্তু কিছুদিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, বারাকার ধারণাই সত্যি ।

আব্দুল্লাহ আর ফিরে আসেন নি, সিরিয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করেছেন ।

আমেনার সেই বিরহ ও কষ্টের সময়ে, বারাকা ছিলেন একমাত্র সবচেয়ে কাছের সঙ্গী ।

একসময় আমেনার অপেক্ষা শেষ হয় এবং তিনি জন্ম দিলেন আমাদের প্রিয় নবীকে ।

শেখ ওমর সুলাইমানের বর্ণনা অনুযায়ী, সর্বপ্রথম আমাদের নবীকে দেখার ও স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছিল যে মানুষটির, সে হলো এই আফ্রিকান ক্রিতদাসী ছোট কালো মেয়েটি ।

আমাদের নবীকে নিজ হাতে আমেনার কোলে তুলে দিয়েছিলেন, আনন্দে ও খুশিতে বলেছিলেন,-“আমি কল্পনায় ভেবেছিলাম সে হবে চাঁদের মত কিন্তু এখন দেখছি, সে যে চাঁদের চেয়েও সুন্দর “।

এই সেই বারাকা! নবীজির জন্মের সময় উনার বয়স ছিল তের বছর ।

ছোটবেলায় শিশু নবীকে আমেনার সাথে যত্ন নিয়েছেন, গোসল দিয়েছেন, খাওয়াতে সাহায্য করেছেন,আদর করে ঘুম পাড়িয়েছেন ।

মৃত্যুর সময় আমেনা, বারাকার হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন তাঁর সন্তানকে দেখে শুনে রাখেন ।

বারাকা তাই করেছিলেন ।

বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে, ইয়াতিম নবী চলে আসলেন দাদা আবদুল মোত্তালিবের ঘরে ।

উত্তরাধিকার সূত্রে নবী হলেন বারাকার নতুন মনিব ।

কিন্তু তিনি একদিন বারাকাকে মুক্ত করে দিলেন, বললেন, -“আপনি যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারেন , আপনি স্বাধীন ও মুক্ত ।”

সেই শিশুকাল থেকেই নবী এই ক্রীতদাস প্রথাকে দূর করতে চেয়েছিলেন ।

বারাকা নবীকে ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না । রয়ে গেলেন । মায়ের ছায়া হয়ে পাশে থেকে গেলেন ।

এমনকি নবীজির দাদা উনাকে বিয়ে দেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না । উনার একই কথা, -“আমি আমেনাকে কথা দিয়েছি, আমি কোথাও যাবো না”

তারপর একদিন খাদিজা (রাঃ) এর সাথে নবীজির বিয়ে হলো ।

বিয়ের দিন রাসূল (সাঃ) খাদিজা (রাঃ) এর সাথে বারাকাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ।

তিনি বললেন, “উনি হলেন আমার মায়ের পর আরেক মা “।

বিয়ের পর রাসূল (সাঃ) একদিন বারাকাকে ডেকে বললেন,
-“উম্মি ! আমাকে দেখাশুনা করার জন্য এখন খাদিজা আছেন, আপনাকে এখন বিয়ে করতেই হবে ।”

(নবীজি উনাকে উম্মি ডাকতেন, নাম ধরে ডাকতেন না )

তারপর রাসূল (সাঃ) ও খাদিজা মিলে উনাকে উবাইদ ইবনে জায়েদের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন ।

কিছুদিন পর বারাকার নিজের একটা ছেলে হলো, নাম আয়মান ।

এরপর থেকে বারাকার নতুন নাম হয়ে গেলো “উম্মে আয়মান”।

একদিন বারাকার স্বামী উবাইদ মৃত্যু বরণ করেন, নবীজি গিয়ে আয়মান ও বারাকাকে সাথে করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন এবং সেখানেই থাকতে দিলেন ।

কিছুদিন যাওয়ার পর নবীজি একদিন বেশ কয়েকজন সাহাবীকে ডেকে বললেন,

“আমি একজন নারীকে জানি, যার কোন সম্পদ নেই, বয়স্ক এবং সাথে একটা ইয়াতিম সন্তান আছে কিন্তু তিনি জান্নাতি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি একজন জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চাও?”

এইকথা শুনে জায়েদ ইবনে হারিসা (রাঃ) নবীজির কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন ।

নবীজি উম্মে আয়মানের সাথে কথা বলে বিয়ের আয়োজন করলেন ।

বিয়ের দিন রাসূল (সাঃ) জায়েদকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে ও ভালোবাসায়, ভেজা চোখে, কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন,- “তুমি কাকে বিয়ে করেছো, জানো জায়েদ ?”

-হাঁ, উম্মে আয়মানকে – জায়েদের উত্তর

নবীজি বললেন,

-“না, তুমি বিয়ে করেছো, আমার মা কে ”

সাহাবীরা বলতেন –
রাসূল (সাঃ) কে খাওয়া নিয়ে কখনো জোর করা যেত না । উনি সেটা পছন্দ করতেন না । কিন্তু উম্মে আয়মান একমাত্র নারী, যিনি রাসূল (সাঃ) কে খাবার দিয়ে “খাও”..” খাও”.. বলে তাড়া দিতেন । আর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকতেন ।

নবীজি মৃদু হেসে, চুপ চাপ খেয়ে নিতেন ।

রাসূল (সাঃ) উনার দুধ মাতা হালিমাকে দেখলে যেমন করে নিজের গায়ের চাঁদর খুলে বিছিয়ে তার উপর হালিমাকে বসতে দিতেন ঠিক তেমনি মদিনায় হিজরতের পর দীর্ঘ যাত্রা শেষে উম্মে আয়মান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন নবীজি উনার গায়ের চাদরের একটা অংশ পানিতে ভিজিয়ে, উম্মে আয়মানের মুখের ঘাম ও ধুলোবালি নিজ হাতে মুছে দিয়েছিলেন ।

এবং বলেছিলেন,- “উম্মি ! জান্নাতে আপনার এইরকম কোন কষ্ট হবে না”

নবীজি মৃত্যুর আগে সাহাবীদের অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলেন ।

সেই সব কথার মধ্যে একটা ছিল, উম্মে আয়মানের কথা ।

বলেছেন,- “তোমরা উম্মে আয়মানের যত্ন নিবে, তিনি আমার মায়ের মত । তিনিই একমাত্র নারী, যিনি আমাকে জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন। আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি সারাজীবন আমার পাশে ছিলেন ।”

সাহাবীরা সেই কথা রেখেছিলেন ।

গায়ের রং নয়, এক সময়ের কোন ক্রিতদাসী নয়, তাঁর পরিচয় তিনি যে প্রিয় নবীর (সঃ) আরেক মা ।

মায়ের মতোই রাসুলুল্লাহর (সঃ) সাহাবারা এই বৃদ্ধা নারীকে ভালোবেসে আগলে রেখেছিলেন।

(সূত্র: সীরাতে ইবনে হিশাম ও শেখ ওমর সুলাইমান, “Woman who cared forever”)

About the author