নবীজীর সম্মানিত স্ত্রীগণের পরিচয়

নবীজির মোট এগারোজন স্ত্রী ছিলেন। জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেছেন দু’জন। হযরত খাদিজা ও উম্মুল মাসাকিন যায়নব রাযি.। বাকি নয়জন স্ত্রী রেখে গেছেন আয়েশা, হাফসা, উম্মে হাবীবা, যয়নব বিনতে জাহাশ, উম্মে সালামা, মাইমুনা, সাওদা, জুওয়াইরিয়া ও সাফিয়া রাযি.।

নিম্নে উম্মাহাতুল মুমিনীনদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো-

খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ: খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুল ওযযা ইবনে কুসাই রাযি.। তার বংশধারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পঞ্চম পুরুষ কুসাই ইবনে কিলাব-এর সাথে মিলিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কুরাইশ নারীদের মধ্যে বংশধারা ও মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ এবং সম্পদে ধনাঢ্য। (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/১৮৯)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিয়ের প‚র্বে তার আরও দু’বার বিয়ে হয়েছিল। প্রথমে আতিক ইবনে আবিদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাখযুম-এর সাথে। এই ঘরে একটি ছেলে ‘আব্দুল্লাহ’ ও একটি মেয়ে ‘হিন্দ’ জন্মগ্রহণ করে। হিন্দ মুসলমান হয়েছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, খÐ ২, পৃষ্ঠা ৬৪৪) আতিক মারা যাওয়ার পরে তিনি বিবাহ করেন আবু হালা ইবনে নাবাশ ইবনে যারারা তামীমিকে। তিনিও মারা গেছেন। এই ঘরেও হিন্দ ও হালা নামে দুটি ছেলে সন্তান হয় এবং উভয়েই মুসলমান হয়েছেন।
হযরত খাদিজা রাযি. নবীজির সততা ও বিশ^স্ততার কথা জানতে পেরে তাঁকে ব্যবসায় নিয়োগ করেন। পরে তাঁর আগ্রহেই নবীজিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে বিবাহ হয়। সে সময় নবীজির বয়স ছিলো পঁচিশ এং খাদিজার ছিলো চল্লিশ। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯৪) তিনি জীবিত থাকতে নবীজি কাউকে বিবাহ করেন নি। ইবরাহীম ছাড়া নবীজির সকল সন্তানের জন্ম হয় খাদিজা রাযি.-এর গর্ভে থেকে।

সাওদা বিনতে যাময়া: সাওদা বিনতে যাময়া ইবনে আব্দুশ শামসকে খাদিজা রাযি.-এর ইন্তিকালের পরে নবীজি বিবাহ করেন, মক্কায়।
এর আগে সাওদা তার চাচার ছেলে সাকবান ইবনে আমর-এর বিবাহধীন ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হাবশায় দ্বিতীয় হিজরত করেন। হাবশার মুহাজিরদের সাথে মক্কায় ফেরার পর সাওদার স্বামী মারা যান।
মদিনায় হিজরতের পর বার্ধক্য এসে পড়লে তার আশংকা হয়, নবীজি তাকে তালাক দিয়ে দেন কি না, যদিও নবীজির পক্ষ থেকে এমন কোনো আচরণ পাননি। তাই তার জন্যে নবীজিকে পাওয়ার নির্ধারিত দিনটি আয়শাকে দিয়ে দেন। তিনি ইন্তেকাল করেছেন ওমর রাযি.-এর খেলাফতের শেষ দিকে। (শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব ৩/২২৯)

আয়শা সিদ্দিকা: আয়শা বিনতে আবু বকর সিদ্দিক রাযি. জন্মগ্রহণ করেন ইসলামের আবির্ভাবের পরে। (বুখারি, হাদীস ৩৯০৫) তার মা উম্মে রুমান প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন, মদিনায় হিজরত করেছেন এবং ষষ্ঠ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। নবুয়তের দশম বছরে নবীজিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বিবাহ হয়। তিনি তখন ছয় বছর বয়সী। নয় বছর বয়সে মদিনায় আগমনের সাত মাস পরে প্রথম হিজরির শাওয়াল মাসে বাসর হয়। (বুখারী, হাদিস ৫১৩৩)
আয়শা রাযি. হলেন নবীজিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবাহিত একমাত্র কুমারী নারী। অল্প বয়স হওয়ায় নবীজিকে তাকে খেলার সাথিদের আমার সাথে খেলার স্বাধীনতা দিতেন। (বুখারী, হাদিস ৬১৩০) তিনি ছিলেন নবীজির সবচে প্রিয় মানুষ। (বুখারী, হাদীস ৩৬৬২) তিনি ছাড়া অন্য কারও সাথে একবিছানায় থাকাকালে নবীজিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ওহী নাযিল হয়নি। (বুখারি, হাদিস ৩৭৭৫)
তিনি ছিলেন উম্মতের মধ্যে সবচে বড় ফকীহ নারী এবং নারী-সাধারণের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী। বড় বড় সাহাবী তার বক্তব্যের দিকে ‘রুজু’ হতেন এবং তার ফতোয়া গ্রহণ করতেন। (যাদুল মাআদ ১/১০৬) সাওদা রাযি.-কে বাদ দিলে তিনিই সবচে বেশি নবীজির নৈকট্য লাভ করেছেন। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশ’ দশটি। (আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাতুস সাহীহিয়্যা, ২/৬৪৯) তিনি ইন্তিকাল করেন ৫৮ হিজরির রমজান মাসে। আবু হোরায়রা রাযি. তার জানাযার নামায পড়ান।

হাফসা বিনতে ওমর: হাফসা বিনতে ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. জন্মগ্রহণ করেন নবুয়তের পাঁচ বছর প‚র্বে। তার মা হলেন যায়নব বিনতে মাযঊন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হিজরত করেন তার স্বামী খুনাঈস ইবনে হুযাফা সাহমি রাযি.-এর সাথে; যিনি বদরে অংশ নিয়ে আহত হয়েছেন এবং সেই জখমে শহিদ হয়েছেন। তৃতীয় হিজরিতে নবীজি তাকে বিবাহ করেন। তার থেকে ৬০টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার ইন্তেকাল হয় মদিনায় ৪৫ হিজরিতে।

উম্মুল মাসাকিন যায়নব: তার নাম যায়নাব বিনতে খুযায়মা ইবনে হারেস হিলালিয়া। মিসকিনদের খাওয়ানোর কারণে তাকে জাহেলি যুগে ‘উম্মুল মাসাকিন’ (মিসকিনদের জননী) ডাকা হতো। তার প‚র্বের স্বামী ছিল নবীজির ফুপাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ; যিনি উহুদ যুদ্ধে শহিদ হন। ইদ্দত শেষ হওয়ার পরে নবীজি তাকে বিবাহ করেন। কিন্তু দুই-তিন মাসের মধ্যে তার ইন্তেকাল হয়ে যায়।

উম্মে সালামা: তিনি হলেন হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে মুগিরা মাখযুমি। প‚র্বে তার বিয়ে হয় নবীজিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুপাতো ভাই আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদের সাথে। স্বামীর সাথে প্রথমবারে হাবশায় হিজরত করলে সেখানে একটি মেয়ে ‘যায়নাব’-এর জন্ম হয়। এরপর সালামা, ওমর ও দুররা নামে আরও তিন সন্তানের জননী হন তিনি। স্বামীর সাথে মদিনায়ও হিজরত করেন তিনি। আবু সালামা রাযি. বদর ও উহুদে শরিক হন। পরে একটি অভিযানে উহুদের পাওয়া আঘাত তাজা হয়ে গেলে চতুর্থ হিজরির জুমাদাল উখরা মাসে ইন্তেকাল করেন। (শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব, ৩/২৩৯)
ইদ্দত শেষ হলে নবীজি তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী নারী এবং একজন ফকীহও বটে। (নাসায়ি, হাদিস ৩২৫৪)] তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা তিনশো আটাত্তর। উম্মাহাতুল মুমিনীনের মধ্যে তিনি সবার শেষে ইন্তেকাল করেন, কারো মতে তেষট্টি হিজরি। সে সময় তার বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর। (শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব ৩/২৪১)

যায়নাব বিনতে জাহাশ: তার নাম যায়নাব বিনতে জাহাশ ইবনে রুআব আসাদিয়া। তার মা হলেন উমাইমা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। নবীজির আদেশে তিনি আজাদকৃত দাস যায়েদ ইবনে হারেসার রাযি. স্ত্রী হন। কিন্তু বংশ-গৌরবের কারণে তিনি নিজেকে যায়েদের চেয়ে ঊর্ধ্বে মনে করতেন। যায়েদ রাযি. অবশেষে তালাক দিয়ে দেন। ইদ্দত শেষ হওয়ার পর নবীজি তার উদ্দেশে বিবাহের পায়গাম পাঠান। আয়াত নাযিল হয়- এরপর যখন যায়েদ আপন স্ত্রী থেকে প্রয়োজন প‚রণ করে নিলো, তখন আমি তাকে আপনার বিবাহে দিয়ে দিলাম, যাতে মুসলমানদের জন্য নিজেদের পালক-পুত্রের স্ত্রীদের বিয়ে করতে কোনো সমস্যা না থাকে। (সূরা আহযাব, আয়াত: ৩৭) এর ফলে পঞ্চম হিজরীতে নবীজী আকদ ও মোহর ছাড়াই তাকে গ্রহণ করেন। যায়নাব রাযি. অন্য স্ত্রীদের ওপর গর্ববোধ করতেন যে, আল্লাহ এ-বিবাহ আসমানে পড়িয়ে দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস ৭৪২১) তিনি নয়টি হাদিস বর্ণনা করেন। নবীজির ইন্তেকালের পর সর্বপ্রথম বিশ হিজরিতে মদিনায় তার ইন্তেকাল হয়।

জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস মুসতালিকিয়া: ষষ্ঠ হিজরিতে বনি মুসতালিকের যুদ্ধে যুদ্ধবন্দি হিসেবে জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস মদিনায় আসেন। তিনি নবীজির কাছে মুক্তির সাহায্য চাইতে আসেন। তার বাবা ছিলেন গোত্রের সর্দার। নবীজি তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মত হলে সাহাবীগণ তাদের হাতে থাকা বন্দিদের ছেড়ে দেন, যেহেতু তারা এখন নবীজিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শ^শুর-সম্বন্ধীয় আত্মীয়। ফলে বনি মুসতালিকের শতাধিক সদস্য মুক্তি পায়। (মিন মায়ীনিস সীরাত ৩০৩) তিনি ছিলেন মিষ্টি লাবণ্যময়ী চেহারার নারী। (আবু দাউদ, হাদসি ৩৯৩১) মোট পাঁচটি হাদীস তিনি বর্ণনা করেন। পঞ্চাশ হিজরীতে তার ইন্তেকাল হয়।

উম্মে হাবিবা বিনতে আবুসুফিয়ান: তিনি প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আবিসিনিয়ার দ্বিতীয় হিজরতে তিনি ও তার স্বামী আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ উভয়ে শরিক ছিলেন। কিন্তু তার স্বামী সেখানে গিয়ে খ্রিষ্টান হয় এবং আবিসিনিয়ায় থাকতেই মারা যায়। ষষ্ঠ হিজরীতে নবীজীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজ্জাশির মাধ্যমে তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। নাজ্জাশি তাকে বিবাহ দিয়ে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে চারশো দিনার মোহর পরিশোধ করেন। বিবাহে তার অভিভাবক ছিলেন খালেদ ইবনে সায়িদ ইবনুল আস রাযি.। তার থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে পয়ষট্টিটি। ৪৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

সাফিয়া বিনতে হুয়াই:মুসলমানরা সপ্তম হিজরিতে খায়বার বিজয় লাভ করেন।যুদ্ধবন্দি হয়ে মদিনায় আসেন সাফিয়া বিনতে হুয়াই আখতাব। তিনি দাহিয়া কালবি রাযি.এরদাসী ছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন কুরাইযা ও নাযির উভয় গোত্রের সর্দারের মেয়ে। জানতে পেরে নবীজি তাকে মুক্ত করে দেন এবং বিবাহ করে নেন। (আবু দাউদ, হাদিস ৩৯৩১) এ-সময় নবীজি মদিনা ও খাইবারের মধ্যর্বুী একস্থানে অবস্থান করেছিলেন। খেজুর, পনির ও মাখন দিয়ে অলিমা আয়োজন করা হয়। (বুখারি, হাদিস ৫০৮৫)
এর আগে সাফিয়া রাযি. স্ত্রী ছিলেন কেনানা ইবনে আবু হাকিক-এর; যে খাইবার যুদ্ধে নিহত হয়। তিনি মোট দশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। ৫০ হিজরিতে রমজান মাসে তাঁর ইন্তেকাল হয়।

মায়মুনা বিনতে হারিস হিলালিয়া: নবীজি তাকে বিবাহ করেন ওমরায়ে কাযা আদায় করতে গিয়ে (বুখারি, হাদিস ৪২৫৯) খাইবার যুদ্ধের পরে সপ্তম বর্ষে। তিনিই নবীজির সর্বশেষ স্ত্রী। তাঁর বোন উম্মে ফযল লুবাবাতুল কুবরা ছিলেন নবীজির চাচা আব্বাস রাযি.-এর স্ত্রী এবং তাঁর বৈপিত্রেয় বোন সালামা বিনতে উমাইস ছিলেন আরেক চাচা হামযা রাযি.-এর স্ত্রী। আব্বাস রাযি.-ই তাকে নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে বিবাহ করিয়ে দেন। (আলমাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ ২/৮৯) ওমরার সময় যেহেতু কুরাইশরা তাকে মক্কায় থাকতে অনুমতি দেয়নি, তাই সারিফ নামক স্থানে তার সাথে বাসর করেন। ৫১ হিজরিতে সেই সারিফেই ইন্তেকাল করেন। এর আগে তিনি আবু রাহম ইবনে আব্দুল ওযযার স্ত্রী ছিলেন, যিনি মারা গেছেন। তিনি মোট বর্ণনা করেছেন ছিয়াত্তরটি হাদিস।

About the author