রাসূলুল্লাহ সা. এর অনুপম দেহাবয়ব

মুসলিম উম্মাহ সাহাবায়ে কেরামের কাছে এজন্য চিরঋণী যে, তারা একদিকে যেমন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যন্তরীণ গুণাবলি তথা আল্লাহপ্রদত্ত অসাধারণ জ্ঞান-গরিমা, কর্মজীবন ও তত্ত্বপূর্ণ বাণীসমূহ পরবর্তী উম্মতের কাছে পৌছে দিয়ে গেছেন, অপরদিকে তেমনি তার। বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য ও অপরূপ দেহাবয়বও উম্মতের সামনে তুলে ধরেছেন।

ইমাম তিরমিযী এই প্রকার চারশাে হাদীস সংকলন করে একটি বিশাল গ্রন্থ রচনা কছেন। এই চারশাে হাদীসকে তিনি ছাপ্পান্নটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে প্রথম অধ্যায়ে চৌদ্দটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। দেহাবয়ব সম্পর্কিত এই হাদীসগুলাে এখানে উল্লেখ করা হলাে—

এক, হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব লম্বা ছিলেন না। আবার খুব খাটোও নন, বরং তার উচ্চতা ছিল মাঝারি। গায়ের রঙ একেবারে চুনের মত সাদা বা গােধূম অথবা শ্যামলা ছিল না (বরং তিনি ছিলেন চতুর্দশী রাতের চাঁদের চেয়ে অধিক উজ্জ্বল, নূরানি ও কমনীয় চেহারার)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কেশ একেবারে সােজা ছিল না বা একেবারে কুঞ্চিতও ছিল। (বরং বলা চলে তাঁর চুল সামান্য কোঁকড়ানাে ছিল), আবার পুরােপুরি কোঁকড়ানাে ছিল না। চল্লিশ বছর বয়ঃক্রমকালে তাকে আল্লাহ তাআলা নবুওয়াত দান করেন। অতঃপর তিনি দশ বছর মক্কায় অবস্থান করেন। (এতে কথা আছে, যা পরে উল্লেখ করা হচ্ছে)। এ সময়ের মধ্যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ওহীও অবতীর্ণ হতে থাকে। এরপর দশ বছর মদীনায় বসবাস করেন। এরপর ষাট বছর বয়সে তিনি পরম প্রভুর সাথে মিলিত হন। তখন তাঁর মাথায় ও দাড়ি মােবারকের পাকা চুলের সংখ্যা বিশটিরও কম ছিল।

ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক উচ্চতা মাঝারি ধরনের ছিল। হিন্দ ইবনে আবু হালা প্রমুখের রেওয়ায়েতে এ কথা স্পষ্ট উল্লিখিত হয়েছে। এ দুটি রেওয়ায়েতের সাথে অপর একটি রেওয়ায়েতের বিরােধ রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনাে গণজমায়েতে দণ্ডায়মান হতেন, তখন সকলের অপেক্ষা উঁচু দৃষ্টিগােচর হতেন। এই বিরােধের জবাব এই যে, এই উচ্চতা শারীরিক উচ্চতার কারণে ছিল না, বরং এটা ছিল তাঁর মােজেযা, যাতে অভ্যন্তরীণ গুণাবলিতে যেমন কেউ তাঁর চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন না, তেমনি বাহ্যিক আকৃতিতেও কেউ তাঁর চেয়ে উঁচু অনুভূত হতাে না।

এ ছাড়া এই হাদীসে নবুওয়াত লাভের পর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা মুকাররমায় দশ বছর অবস্থান করার কথা উল্লিখিত হয়েছে; -এর ভিত্তিতেই তাঁর বয়স ষাট বছর বলা হয়েছে। কিন্তু এই রেওয়ায়েতটি সেই সমস্ত রেওয়ায়েতের খেলাফ, যেগুলােতে তাঁর অবস্থান তেরাে বছর এবং বয়স তেষট্টি বছর বলা হয়েছে। কোনাে কোনাে রেওয়ায়েতে বয়স পঁয়ষট্টি বছর বর্ণিত আছে। ইমাম বুখারী বলেন, তেষট্টি বছরের রেওয়ায়েত বেশি। আলেমগণ দু’প্রকারে এ সকল হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন

ক. হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত পান এবং তিন বছর পরে রেসালাত পান। এরপর তিনি দশ বছর মক্কায় অবস্থান করেন। এ ভিত্তিতে আলােচ্য হাদীসে নবুওয়াত ও রেসালাতের মধ্যবর্তী তিন বছরের উল্লেখ বাদ পড়েছে।

খ. কোনাে কোনাে ভাষায় সাধারণত সংখ্যাতত্ত্বে একক সংখ্যাগুলাে গণনা করা হয় না। এ কারণেই হযরত আনাসের রেওয়ায়েত দশ ও ষাট উভয় জায়গায় দশক উল্লেখ করা হয়েছে এবং একক সংখ্যা বাদ দেওয়া হয়েছে। যে রেওয়ায়েতে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স পঁয়ষট্টি বছর উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে জন্মসাল মৃত্যুসালকে স্বতন্ত্র গণনা করা হয়েছে। মােটকথা, সকল রেওয়ায়েতের সারকথা একই।

দুই. দ্বিতীয় রেওয়ায়েত হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝারি উচ্চতাবিশিষ্ট ছিলেন না বেশি লম্বা, না বেশি খর্বাকৃতি। তাঁর দেহ ছিল অত্যন্ত সুশ্রী ও সুষম। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কেশ না একেবারে কুঞ্চিত ছিল, না একেবারে সােজা (বরং তাতে কিছু কিছু কুঞ্চন ছিল)। তার শরীরের রঙ ছিল গােধূম। যখন তিনি পথ চলতেন, তখন সম্মুখের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে চলতেন।

ব্যাখ্যা : এ হাদীসে স্বয়ং হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীরের রঙ ছিল গােধূম। প্রথম রেওয়ায়েতও হযরত আনাসেরই ছিল—তাতে তিনি বলেছিলেন, তাঁর গায়ের রঙ একেবারে গােধূম ছিল না। এতদসত্ত্বেও উভয় রেওয়ায়েতের মধ্যে কোনাে বৈপরীত্ব নেই। উভয় রেওয়ায়েতের সারমর্ম এই যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রঙ একেবারে গােধূম ছিল না, যে কারণে ঔজ্বল্য ও সৌন্দর্যে কিছু ত্রুটি থেকে যায়, বরং তার রঙে এমন চাকচিক্য ও উজ্জ্বলতা ছিল, যার সাথে কিছুটা গােধূম রঙও মিশ্রিত ছিল।

About the author