দিবা-রাত্রির কার্যসূচি

দিনরাত্রির তিন ভাগের এক ভাগ সময় ইবাদত-বন্দেগির জন্যে, একভাগ পরিবার-পরিজন ও গৃহকর্মের মধ্যে এবং এক ভাগ নিঃস্ব-দুঃস্থজনদের সেবায় ব্যয় করতেন। কোনাে জরুরি অবস্থা দেখা না দিলে সাধারণত এনিয়মের ব্যত্যয় ঘটত না।

ফজরের নামায শেষ হওয়ার পর জায়নামাযেই লােকজনের প্রতি মুখফিরিয়ে বসতেন। এক প্রহর পর্যন্ত এ আসনে বসে সাহাবীগণের প্রতিউপদেশ দিতেন। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতেন। কোনাে সমস্যারসৃষ্টি হলে সে সম্পর্কে পরামর্শ করতেন। এককথায় এ সময়টিই ছিলদরবারে নববীর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিদেশি প্রতিনিধি এবং বিভিন্নগােত্রের তরফ থেকে আগত লােকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ দানের সময়ও ছিলএটিই। এই বৈঠকেই বিচারাদিও নিষ্পত্তি এবং অভিযােগ শােনা হতাে।বৈঠক শেষে চাশতের নামায পড়ে ঘরে ফিরে আসতেন। অতঃপর সাধারণএকজন গৃহীর ন্যায় দৈনন্দিন কাজকর্মে লেগে যেতেন । গৃহপালিত পশুপরিচর্যা, দুগ্ধ দোহন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, বাজার থেকে প্রয়ােজনীয়জিনিসপত্র খরিদ করে আনা, পুরনাে কাপড় ও জুতাে সেলাই করা প্রভৃতিকাজ নিজ হাতেই করতেন।

যােহরের নামাযের আগেই খাওয়ার কাজ সেরে নিয়ে সামান্য কিছুক্ষণবিশ্রাম করতেন। নামায শেষে পুনরায় মসজিদ বা বাইরে কোথাও গিয়ে।তাবলীগ ও তালীমের কাজ করতেন। আসরের নামাযের পর অন্তঃপুরে।চলে গিয়ে সহধর্মিনীগণের সাথে কথাবার্তা বলতেন। বিভিন্ন সমস্যা নিয়েআগত মহিলাদের মধ্যে তালীমের কাজ এ সময়ই সমাধা করা হতাে।এশার আগেই পর্যায়ক্রমে কোনাে এক স্ত্রীর ঘরে পরিবারের সবাইকে নিয়েকিছুক্ষণ কাটাতেন। এশার নামায শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় চলেযেতেন। এশার পর রাতজাগা তিনি পছন্দ করতেন না।

রাতের অর্ধপ্রহর পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠতেন। উজুর পানি ওমেসওয়াক হাতের কাছেই রাখা থাকত। প্রথমে ভালােভাবে মেসওয়াককরতেন। রাত-নিশীথে শয়নের বিছানাই হতাে তাঁর নামাযের স্থান।

জীবনের কোনাে সময় এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়াযায়নি, বরং কোনাে কোনাে সময় এশার পর নামমাত্র সামান্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে ফজর পর্যন্ত শুধু নামায এবং কান্নাকাটি করে কাটিয়েছেন বলে বর্ণনায় পাওয়া যায়।

বিছানা ও আসবাবপত্র

জীবনের অধিকাংশ সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটির ওপর চাটাইয়ের বিছানা করে শুয়েছেন। শেষ বয়সে চামড়ার মধ্যে খেজুরপাতা ও আঁশ ভরে একটি গদি তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। এই বিছানাতেই একটি তালি দেওয়া কালাে কম্বলে আবৃত অবস্থায় ত্রিভুবনের ‘শাহানশাহ’ এ দুনিয়া হতে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তার ঘরে আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল একটি বিছানা, পানি রাখার জন্যে একটি চামড়ারমশক, পানি পান করার একটি কাঠের পেয়ালা এবং কয়েকটি টুকিটাকিঅস্ত্র। জীবনের শেষ রাতটিতে তার ঘরে বাতি দেওয়ার মতাে তৈল ছিলনা, অথচ তিনি ছিলেন লাখাে বর্গমাইল বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্যেরএকচ্ছত্র অধিপতি।

বাসস্থান

মহানবীর বাসস্থান ছিল মসজিদে নববীর পাশে ছয় হাত চওড়া এবংআট হাত লম্বা কয়েকটি কুটির। এগুলােতে খেজুর পাতার ছাউনি ছিল।একেকটি কুটিরে মুসলিম-জননীগণের একেকজন বাস করতেন। রােদ-বৃষ্টিথেকে পরিপূর্ণভাবে আত্মরক্ষার মতাে ব্যবস্থাও এ সমস্ত কুটিরে ছিল না।বিদেশি মেহমান এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সাথে বসে আলাপ-আলােচনা করার জন্যে সাহাবীগণ মসজিদে নববীর সামনে আরেকটি কুটিরতৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই কুটিরে কয়েকটি শুকনাে চামড়ার আসন ছাড়াআর কোনাে আসবাব ছিল না।গােটা আরবের ওপর আধিপত্য বিস্তৃত হওয়ার পর সাহাবীগণ মহানবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনাে অবস্থাতেই এরূপ করার অনুমতি প্রদান করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল— দুনিয়ার আরাম-আয়েশের সাথে আমার সম্পর্ক থাকতে পারে না। আমি একজন মুসাফির ছাড়া তাে আর কিছু নই। একজন পথচারী যেমন ছায়াদার কোনাে গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করে, মানুষের জীবনটুকুও ঠিক তেমনি। মানুষ এখানে আরাম করার জন্যে আসেনি, এসেছে কঠোর কর্তব্য সমাধা করে অনন্ত জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতে।

About the author