রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ কথাবার্তা ছিল অত্যন্ত মধুর, কোনাে কারণে বিরক্ত হলেও মুখাকৃতিতে বা আওয়াজে তা প্রকাশ পেত না। ক্রোধের উদ্রেক হলেও শুধু চেহারার বর্ণ লাল হয়ে যেত।
লােকজনের সাথে কথাবার্তা বলার সময় সুস্পষ্ট উচ্চারণে বলে যেতেন। উপদেশ দেওয়ার সময় অপ্রাসঙ্গিক কোনাে কথা বলতেন না। প্রতিটি বিষয় আলাদা আলাদাভাবে অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে বলে যেতেন। কোনাে কথার ওপর গুরুত্ব আরােপ করতে হলে একাধিকবার তা উচ্চারণ করতেন। এমন সুস্পষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী ছিল তার বাচনভঙ্গি, শ্রোতামাত্রই তা সহজে অনুধাবন করতে ও সহজে স্মরণ রাখতে পারত। আওয়াজ ছিল গুরুগম্ভীর; কথার মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে, একবার কানে গেলে তা মর্মমূলে গিয়ে প্রবেশ করত। কুরআন পাঠ করার সময় আওয়াজ হয়ে উঠত আবেগময়, বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আওয়াজ উঠানামা করত। হযরত উম্মে হানী বর্ণনা করেছেন, রাসূলে খােদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের গভীরে কাবা শরীফে বসে কুরআন পাঠ করতেন, সেই আওয়াজ আমরা ঘরে শুয়েই সুস্পষ্ট শুনতে পেতাম।
সাহাবী হযরত হিন্দ বর্ণনা করেছেন, রাসূলে খােদাকে দেখলে মনে হতাে, সবসময় যেন তিনি কী এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন। অপ্রয়ােজনীয় কোনাে কথা তাঁর পবিত্র মুখ দিয়ে কখনাে বের হতে কেউ শােনেনি। কথাবার্তার মধ্যে এমন একটি আকর্ষণ ছিল যে, কেউ সে কথার মধ্য মনােযােগ অন্য দিকে সরিয়ে নিতে পারত না।
মহানবীর বাগ্মিতা ছিল অপূর্ব। নবুওয়াতের কথা সর্বপ্রথম ঘােষণা করার সময় মক্কার আবু কুবাইস পর্বতশীর্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার মধ্যেই এমন এক অপূর্ব আবেদন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে অনেকের অলক্ষ্যেই অন্তরের গভীরে ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধাবনত মনােভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী যুগে ইসলাম গ্রহণ করার পর তারা সেই প্রভাবের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। কুরআন পাকের অনুরূপ সুরলহরির পর বাগিতাই ছিল ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে মহানবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। তাঁর বক্তৃতা একবার যে শুনেছে, তার অন্তরেই বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের সূচনা হয়ে গেছে।
বক্তৃতা করার সময় মাঝে মাঝে ডান হাত ওপরে তুলে আঙুল দ্বারা ইশারা করতেন। কোনাে আশ্চর্যজনক বিষয় বােঝানাের সময় কখনাে কখনাে হাতের তালু ঘুরিয়ে নিতেন। আনন্দ প্রকাশ পেলে দৃষ্টি অবনত করে ফেলতেন। অন্যথায় সাধারণত কথাবার্তা বলার সময় দৃষ্টি ওপরে থাকত। কোনাে বিষয় ব্যাখ্যা করার সময় মনে হতাে যেন ছবি এঁকে তিনি শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরছেন। তাঁর মুখে বেহেশত ও দোজখের বর্ণনা শােনার সময় মনে হতাে, তিনি যেন তা দেখে দেখে বর্ণনা করছেন।
সবসময় হাসিমুখে থাকতেন, সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ামাত্র হাসিমুখে অভ্যর্থনা করতেন, কিন্তু জীবনে কোনাে দিন তাকে কেউ অট্টহাসি হাসতে দেখেনি। প্রবল হাসির উদ্রেক হলে কখনাে কখনাে বিদ্যুচ্চমকের মতাে এক ফালি দাঁতের ঔজ্জ্বল্য ফুটে বের হতাে। সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, জীবনে যতবার আমি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করেছি, প্রত্যেকবারই তিনি আমাকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করেছেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার কথা শুনেছেন। কারও মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তিনি কথা বলতেন । একজনের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়ার পর নিজের মন্তব্য প্রকাশ করতেন।
চেহারার মধ্যে এমন একটা জ্যোতি ছিল যে, কেউ কোনদিন তাঁর চোখে-চোখে চেয়েছে, এমন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
ছােট-বড়, ধনী-দরিদ্র এমনকি শিশুদের সাথেও অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কথা বলতেন; সকল শ্রেণির লােকের মর্যাদা প্রদান করতেন। প্রত্যেক আগন্তুকের সাথে উষ্ণ আবেগের সাথে মুসাফাহা করতেন। কিছু দিন বিরতির পর সাক্ষাৎ হলে বুকে বুক লাগাতেন, ললাট চুম্বন করতেন। যে কোনাে লােক কথা বলতে গেলে আগ্রহভরে তা শুনতেন। সাহাবীগণের মধ্যে এমন একটি সাধারণ ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বােধহয় তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালােবাসেন।
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে যখন তিনি ক্ষমতার শীর্ষে তখনও মাঠের রাখাল ছেলে পর্যন্ত মনে করত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার এমন ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব রয়েছে যে, তার যে কোনাে আবদার তিনি রক্ষা করবেন। ফলে মরুচারী অমার্জিত স্বভাবের বেদুইনরাও সময়ে অসময়ে সম্ভব-অসম্ভব নানা প্রকার আবদার নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হতাে। কিন্তু তিনি কখনাে কারও প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, এমন কোনাে ঘটনা কেউ বর্ণনা করতে পারেনি।
পথে হেঁটে যেতে প্রথমে তিনি সালাম দিতেন। ছােট ছােট বাচ্চাকে ডেকেও কুশলবার্তা জিজ্ঞেস করতেন। তাদের খেলাধুলা, ছাগলছানা, পালিত পাখির ছানা সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভুলতেন না। শিশুরাও তাদের আবদারের কথা অকপটে তার কাছে বর্ণনা করত। বিত্ত, বয়স বা মাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে যে যেখানেই থাকুক না কেন, নিজের কথা অকপটে আলােচনা করতে এসে মহানবীর সামনে কেউ ব্ৰিত বােধ করেনি। কোনাে শ্রেণির লােক থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার প্রবণতাও তাঁর মধ্যে কখনাে দেখা যায়নি। অবসর পেলেই তিনি বের হতেন। অলিতে-গলিতে, এমনকি ক্ষেত-খামার এবং পশুপালনের চারণভূমিতে পর্যন্ত গিয়ে সবার সাথে প্রাণখােলা আলাপ করতেন। সকল শ্রেণির মানুষের সমস্যা ও হাসি-কান্নার সাথে আন্তরিকভাবে শরিক হতেন।