আমাদের নবীজি (সা.) বিশ্বনবী। শুধু মানুষের নবী নন, জ্বিনেরও নবী। সবার নবী। তিনি সবার জন্যে হেদায়াত নিয়ে এসেছেন। আলো নিয়ে এসেছেন। হক নিয়ে এসেছেন:
= আমি আপনাকে পুরো বিশ্বের জন্যে রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি (আম্বিয়া:১০৭)।
= মহিমান্বিত ঐ সত্ত্বা যিনি ‘ফুরকান’ নাযিল করেছেন তার বান্দার ওপর। যেন তিনি বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হতে পারেন (ফুরকান: ১)।
–
(দুই) দাওয়াত গ্রহন
জ্বিনেরও নবীজির দাওয়াত গ্রহণ করেছে:
= আপনি বলুন, আমার প্রতি ওহী নাযিল করা হয়েছে যে: জ্বিনদের একটি দল কুরআন শুনেছে, তারপর তারা বলেছে: আমরা বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি। যা সৎপথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না (সূরাতুল জ্বিন: ১-২)।
= যখন আমি একদল জ্বিনকে আপনার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম, তারা কুরআন পাঠ শুনছিল। তারা যখন কুরআন পাঠের জায়গায় উপস্থিত হলো, তখন পরস্পর বলল, চুপ থাক। অতঃপর যখন পাঠ শেষ হলো, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে সতর্ককারীরূপে ফিরে গেলো।
তারা বলল, হে আমাদের সম্প্রদায়, আমরা এমন এক কিতবা শুনেছি, যা মুসার পর অবতীর্ণ হয়েছে। এ কিতাব পূর্ববর্তী সব কিতাবের প্রত্যয়ন করে, সত্যধর্ম ও সরলপথের দিকে পরিচালিত করে
হে আমাদের সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর কথা মান্য করো এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। তিনি তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন (আহকাফ: ২৯-৩১)।
.
(তিন) পাঠক নবী, শ্রোতা জ্বিন!
আলকামা প্রশ্ন করেছিলেন ইবনে মাসউদ রা.কে:
-আপনাদের কেউ কি জিনের সাথে সাক্ষাত হওয়ার রাতে নবীজির সাথে ছিলেন?
-জ্বি না। সে রাতে ছিলাম না। তবে একরাতে আমরা নবীজির সাথে ছিলাম। তাকে হারিয়ে ফেললাম। সবাই নবীজিকে খুঁজতে শুরু করে দিলাম। উপত্যকায় খুঁজলাম। গিরিপথে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। আমরা বলতে শুরু করলাম: তাকে হয় কোথাও উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে না হয় মেরে ফেলা হয়েছে।
রাতটা যে কিভাবে আমাদের কেটেছে, বলে বোঝানো যাবে না। উদ্বেগে দুশ্চিন্তায় আমাদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। ভোরের দিকে দেখি নবীজি হেরার দিক থেকে হেঁটে আসছেন।
-ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি পুরোটা রাত কোথায় ছিলেন? এদিকে আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান! এমন উদ্বেগজনক রাত আমাদের আর অতীতে যায়নি!
-আমাকে একটা জ্বিন ডাকতে এসেছিল। তার সাথেই গিয়েছিলাম। তাদেরকে কুরআন শুনিয়ে এলাম!
–
এরপর নবীজি আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। জ্বিনদের বিভিন্ন নিদর্শন দেখালেন। তাদের আগুনের চিহ্ন দেখালেন।
-জ্বিনেরা কী খায়?
-তারা তোমাদের ফেলে দেয়া পশুর হাড় খায়। গোবর খায়। তোমরা গোবর ও হাড় দিয়ে ইস্তিনজা করো না। ঢিলা-কুলুফ হিশেবে ব্যবহার করো না। কারণ এ-দুটো তোমাদের জ্বিন ভাইদের খাদ্য! (মুসলিম: ৪৫০)।
–
(চার) কুরআন-শ্রবণ
নবীজি জ্বিনদের প্রশংসা করেছেন। তারা খুবই মনোযোগের সাথে কুরআন কারীম শ্রবণ করে। জাবের রা. বলেছেন:
-একবার নবীজি সাহাবাদের কাছে এলেন। সূরা রহমান তিলাওয়াত করে শোনালেন। আগাগোড়া। সবাই চুপটি করে শুনলো। নবীজি বললেন:
= আমি সূরাটা জ্বিনদেরকেও তিলাওয়াত করে শুনিয়েছিলাম সেই রাতে। তারা তোমাদের চেয়ে ভালো শ্রোতা ছিল। তারা খুবই সুন্দর প্রত্যুত্তর দিয়েছে। আমি যতবার তিলাওয়াত করেছি:
فَبِأيِّ آلاءِ رَبِّكُما تُكَذِّبانِ
তোমরা তোমাদের প্রতিফালকের কোন কোনও নেয়ামত অস্বীকার করবে?
প্রত্যেকবারই জ্বিনেরা বলে উঠেছে:
= হে আমাদের রব! আপনার কোনও নেয়ামতকেই আমরা অস্বীকার করি না। আপনার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা! (তিরমিযী)
.
(পাঁচ) খাবারের চিন্তা!
নবীজি শুধু মানুষ নিয়ে ভাবতেন এমন নয়। জ্বিনদের নিয়েও ভাবতেন। তাদের খাবারের সংস্থান নিয়ে ভাবতেন। আবু হুরাইরা রা. বলেছেন:
-আমি নবীজির সাথে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন:
-আমার জন্যে কয়েকটা পাথর নিয়ে এসো। কুলুফ হিশেবে ব্যবহার করবো। দেখো আবার হাড় বা পশুর বিষ্ঠা নিয়ে এসো না!
আমি পাথর এনে দিলাম। কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম:
-হাড় আর বিষ্ঠা হলে কী সমস্যা?
-এ দু’টি হলো জ্বিনের খাবার। আমার কাছে জিনের প্রতিনিধি দল এসেছিল। তারা আমার কাছে তাদের জন্যে পাথেয় চেয়েছিল। আমি আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে দু‘আ করেছি! যেন হাড় ও গোবরকে তাদের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে দান ব্যবস্থা করে দেন ! (বুখারী)।
–
(ছয়) সতর্কতা
নবীজি মানুষকে সতর্ক করে গেছেন। দুষ্ট জ্বিনদের ব্যাপারে। আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত:
-আল্লাহর রাসূল বলেছেন: মদীনায় কিছু জিন বাস করে। তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। যদি কখনো জ্বিনদের আচরণে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাও, তাদেরকে তিনদিনের সময় দিবে। এরপর তাদেরকে মদীনায় পেলে মেরে ফেলবে। কারণ তারা জ্বিন নয়, শয়তান (মুসলিম:২২৩৬)
–
(ক) দুষ্ট জ্বিনেরা অনেক সময় সাপ বা কুকুর বা অন্য কোনও প্রাণীর সুরত ধরে মানুষকে ভয় দেখায়, ক্ষতি করার চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় তাদেরকে সাপের ছবি ধরে থাকাবস্থায় মেরে ফেললে কোনও গুনাহ হবে না। তবে আগে তিনবার সতর্ক করা কাম্য।
–
(খ) মানুষকে যেমন অন্যায়ভাবে হত্যা করা ঠিক নয়, জ্বিনকেও অন্যায়ভাবে মারা ঠিক নয়:
= কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে অবিচার করার প্রতি উৎসাহিত করে না তোলে (মায়িদা: ৮)।
–
(সাত) শয়তান থেকে পানাহ
নবীজিও দুষ্ট জ্বিনের দুষ্টুমি থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন। আবুদ্দারদা রা. বলেছেন:
-একবার নবীজি নামাজে দাঁড়িয়েছেন। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন:
= আমি আল্লাহর কাছে তোমার ব্যাপারে পানাহ চাই। তোমার ওপর আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হোক।
তিনবার বাক্যটা উচ্চারণ করলেন। নামাজের মধ্যেই হাতটা প্রসারিত করে দিলেন। যেন কিছু একটা ধরতে চাচ্ছেন। আমরা অবাক! তিনি এমন করছেন কেন? নামাজ শেষ হলো। আমরা জানতে চাইলাম:
-ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ নামাজে কিছু বাক্য বললেন, হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরতে চাইলেন। এমনটা তো আগে কখনো করতে দেখিনি?
-আজ আল্লাহর শত্রু ইবলীস এসেছিল। একটা জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে। ওটা আমার চেহারায় লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছি। তিনি বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এরপর আমি তাকে ধরতে গেলাম। কিন্তু জ্বিনকে বন্দী করা একমাত্র নবী সুলাইমানের বৈশিষ্ট্য! তিনি যদি দু‘আ করে না যেতেন, আজ জ্বিনটাকে বন্দী করে ফেলতাম। মদীনার শিশুরা তাকে নিয়ে খেলতে পারতো! (মুসলিম:৫৪২)।
–
(ক) সুলাইমান আলাইহিস সালাম দু‘আ করেছিলেন:
-ইয়া রাব! আমাকে ক্ষমা করুন। আর আমাকে দান এমন রাজত্ব (ক্ষমতা) দান করুন, যা আমার পরে আর কেউ পাবে না সোয়াদ:৩৫)।
নবীজি এই দু‘আর দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। জ্বিনদের ওপর কর্তৃত্ব আমার ভাই সুলাইমানের জন্যেই থাক।
–
(খ) শয়তান জ্বিন নবীজিকে পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে কসুর করতো না। আমাদের অবস্থা কেমন হবে সহজেই অনুমেয়।
–
(গ) জ্বিন জাতির অস্তিত্ব সত্য। এই বিশ্বাস রাখা ঈমানের অঙ্গ। জ্বিনজাতিকে অস্বীকার করার অর্থ কুরআন হাদীস অস্বীকার করা।
নবীজি যখন ‘জ্বিনের নবী’!
মসজিদে জিন