নবীজীর নামে কটুক্তির শাস্তি

আল্লাহ তাআলা মানুষের সৃষ্টিকর্তা। ইসলাম তাঁর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। মানুষের জন্য তিনি এই দ্বীন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ-ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন বা ধর্ম মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের অনুসরণ করবে, তার পক্ষ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (আলে ইমরান ৩ : ৮৫)

যারা ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছুর অনুসারী, তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান করা হবে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ

দ্বীন (গ্রহণ)-এর বিষয়ে কোনো জবরদস্তি নেই। হেদায়েতের পথ গোমরাহী থেকে পৃথকরূপে স্পষ্ট হয়ে গেছে। (বাকারা ২ : ২৫৬)

আর যারা আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা পরিপূর্ণরূপে ইসলাম অনুসরণে বাধ্য। তারা তো ইসলাম গ্রহণ করেছেই আল্লাহর ইবাদতের জন্য, তাঁর বিধান মানার জন্য। ইরশাদ হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ

‘তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (বাকারা ২ : ২০৮)

অন্য আয়াতে এসেছে-

وَإِذْ نَتَقْنَا الْجَبَلَ فَوْقَهُمْ كَأَنَّهُ ظُلَّةٌ وَظَنُّوا أَنَّهُ وَاقِعٌ بِهِمْ خُذُوا مَا آَتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

‘এবং স্মরণ কর, যখন আমি পাহাড়কে তাদের উপর এভাবে তুলে ধরলাম, যেন একটি শামিয়ানা, আর তারা ভেবে নিয়েছিল, এটি তাদের উপর পতিত হবে, (তখন আমি হুকুম দিয়েছিলাম) আমি তোমাদেরকে যে কিতাব দিয়েছি, তা মজবুতভাবে আকড়ে ধর এবং তাতে বর্ণিত বিষয়সমুহ স্মরণ রাখ। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।’ (আরাফ ৭ : ১৭১)

মুসলমান ইসলামের অনুশাসন মানতে বাধ্য বলেই গুনাহ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে বিভিন্ন শাস্তি তার উপর আপতিত হয়। দুনিয়াতে কোনো গুনাহের শাস্তি বন্দিত্ব, কোনোটার শাস্তি বেত্রাঘাত, হস্তকর্তন ও মৃত্যুদন্ড ইত্যাদি। সবচে বড় গুনাহ হল মুসলিম থেকে অমুসলিম হয়ে যাওয়া। একেই বলে ‘মুরতাদ’ হওয়া। ‘মুরতাদ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ বিমুখ হয়েছে বা ফিরে গিয়েছে এমন। এর মূল মর্ম  হল, ইসলাম ত্যাগ করা, ইসলামের কোনো মৌলিক আকিদা বা বিধানকে মানতে অস্বীকার করা, কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা অথবা ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের অবমাননা করা, যা অন্তরের ভক্তিশূন্যতা ও শ্রদ্ধাহীনতার আলামত বহন করে। এককথায় ঈমান বিনষ্টকারী যে কোনো কুফরী-শিরকী আকিদা বা বিশ্বাস পোষণ করা, অথবা এ জাতীয় কোনো কথা বা কাজে লিপ্ত হওয়ার নামই হল ‘ইরতিদাদ’ বা মুরতাদ হওয়া।

যে সকল কারণে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায় এর বিভিন্ন কারণের মধ্য হতে নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।

১. আল্লাহ তাআলার শানে বেয়াদবি করা।

২. ইসলামের শিআর তথা প্রতীকসমূহের অবমাননা করা। এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা কৌতুক করা।

ইসলামের মৌলিক শিআর হল; কুরআন মাজীদ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ; বিভিন্ন ইবাদত যথা-নামায, রোযা, হজ্ব-যাকাত, দোয়া-দরূদ; বিভিন্ন ফযীলতপূর্ণ স্থান যথা-মসজিদে নববী, কা’বা শরীফ, মসজিদে আকসা এবং পৃথিবীর সকল মসজিদ ইত্যাদি। এগুলোর অবমাননা যেমন, মসজিদকে গোয়ালঘর বলা, কোরআন মাজীদকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলা, নবীজীকে যুদ্ধবাজ বলা, তাঁর নামের অবমাননা করা ইত্যাদি।

৩. ইসলামের কোনো বিধান, ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত সাধারণ কোনো বিষয়, নবীজীর কোনো সুন্নত, এমনকি প্রমাণিত কোনো মুস্তাহাব আমল ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার করা অথবা অবজ্ঞা-প্রকাশক কোনো আচরণ করা। যেমন কুকুরের মাথায় টুপি পরানো, বোরকাকে বেশ্যার পোশাক বলা ইত্যাদি।

৪. জরুরিয়াতে দ্বীন তথা সর্বজনবিদিত অকাট্য দ্বীনী বিষয়সমূহের কোনো একটি অস্বীকার করা, অপছন্দ করা, বা তার অপব্যাখ্যা করা, অথবা তার উপর আপত্তি তোলা কিংবা তা সংস্কারযোগ্য বলে মনে করা। যেমন খতমে নবুওত অস্বীকার করা, চুরির শাস্তির উপর আপত্তি করা ইত্যাদি।

৫. ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করা কিংবা কোনো ধর্মই না মানা। যেমন আল্লাহকে বিশ্বাস না করা, প্রকৃতিবাদী হওয়া, খৃস্টান বা তাদের ভাষায় ‘ঈসায়ী মুসলমান’ হওয়া ইত্যাদি।

৬. এমন কোনো কাজ করা বা বিশ্বাস পোষণ করা, যা আল্লাহ তাআলার তাওহীদ পরিপন্থী। যেমন কোনো প্রতিকৃতির সামনে মাথা নত করা, মাজার তওয়াফ করা, উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরিক করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে রিযিকদাতা, ফসলদাতা, সন্তানদাতা ইত্যাদি মনে করা।

৭. অন্যদের ধর্মীয় প্রতীক গ্রহণ করা, কথা বা কাজে এর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করা।

৮. ইসলামী শরীয়ত তথা আল্লাহ রববুল আলামীনের হাকিমিয়্যত (শাসকত্ব)-কে অস্বীকার করা। অর্থাৎ জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহ তাআলা হালাল-হারাম, সিদ্ধ-অসিদ্ধ নির্ধারণকারী এবং তিনিই যে একমাত্র বিধানদাতা তা বিশ্বাস না করা ইত্যাদি।

ইরতিদাদের সকল প্রকার সাধারণ কুফরের চে ভয়াবহ। সাধারণ কুফর হল সত্যদ্বীন গ্রহণ না করা বা প্রকৃত দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা। কিন্তু ইরতিদাদ নিছক বিমুখতা নয়, এ হল বিদ্রোহ, বিরুদ্ধতা! সত্য দ্বীন গ্রহণ করার পর তা বর্জনের অর্থ ঐ দ্বীনকে অভিযুক্ত করা, যা নির্জলা অপবাদ। পাশাপাশি তা ‘ইফসাদ ফিল আরদ’ তথা পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টিও বটে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

كَيْفَ يَهْدِي اللَّهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ  أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ  خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ  إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ  إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ

‘আল্লাহ এমন একটা কওমকে কীভাবে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করতে পারেন; যে সমাজ একবার ঈমান আনার পর, রাসূলকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার পর এবং তাদের কাছে সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ এসে যাওয়ার পর আবার কাফের হয়ে যায়? অবস্থা এই যে, আল্লাহ এমন জালিম সমাজকে কখনো হেদায়েতের পথ দেখান না। এই যে লোকগুলো, এদের কর্মফল হলো, এদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ! তবে এর পরে যারা তওবা করবে আর (নিজেদেরকে) সংশোধন করে নেবে, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। পরন্তু আল্লাহ হচ্ছেন মহাক্ষমাশীল করুণাময়। (কিন্তু) যারা একবার ঈমান আনার পর আবার কাফের হয়ে যায় এবং তাদের কুফরী আচরণ আরও বেড়ে চলে, তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না।’ (আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৯০)

অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-

وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

‘আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যায়। আর সে অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এই লোকেরাই হল জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে থাকবে। (বাকারা ২ : ২১৭)

আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

(তরজমা) ‘প্রকৃতপক্ষে যারা তাদের সামনে হেদায়েত পরিস্ফুট হওয়ার পরও মুরতাদ হয়ে যায়, (আসলে) শয়তান তাদেরকে ফুসলিয়েছে এবং অমূলক আশা দিয়েছে। এসব এজন্য যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়কে অপছন্দ করে, তাদেরকে (সেই কাফেরদেরকে) তারা (মুরতাদ-মুনাফিকেরা) বলে, কিছু কিছু বিষয়ে আমরা তোমাদের কথাও মানবো। (স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ তাদের গুপ্ত কথা সম্পর্কে অবগত। ফেরেশতারা যখন এদের চেহারায় এবং পিছন দিক থেকে আঘাত করতে করতে এদের জান কবজ করবে, তখন এদের কী দশা হবে! এসব (শাস্তি) এজন্য যে, তারা এমন মতবাদ বেছে নিয়েছে, যা আল্লাহ তাআলাকে নারাজ করে এবং তারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন পছন্দ করে না। তাই আল্লাহ তাদের আমলগুলো বরবাদ করেছেন। (মুহাম্মাদ (৪৭) : ২৫-২৮)

মুরতাদের পরকালীন এ শাস্তিগুলির ফয়সালা হবে হাশরের ময়দানে। যেখানে ফয়সালাকারী হবেন খোদ আল্লাহ রাববুল আলামীন। দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বিষয় সম্পর্কে যিনি অবগত। যিনি আহকামুল হাকিমীন। মানুষের অন্তরের একান্ত গোপন কথাও যার অজানা নয়। তাই দুনিয়াতে যে নিজের ইরতিদাদ ও কুফর লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, কেয়ামতের দিন সেও অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাকেও কঠিন আযাব ভোগ করতে হবে।

কিন্তু এই দুনিয়ার আদালতে মনের অবস্থার উপর বিচার করা যায় না। এখানে কারো মনের খবর নিশ্চিতভাবে জানাও সম্ভব হয় না। তাই দুনিয়াতে বিচার হয় বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। কোনো মুনাফিক নিজের অন্তরে কুফরি আকিদা-বিশ্বাস লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলে বিচারকের সামনে তার ইরতিদাদ প্রমাণিত হবে না। সুতরাং দুনিয়াবী কোনো শাস্তিও তার উপর আপতিত হবে না। দুনিয়াবী শাস্তি প্রয়োগ হবে কেবল ঐ ব্যক্তির উপর-যার ইরতিদাদ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং হাকিমের কাছে তা প্রমাণিত হয়েছে।

মুরতাদ দুই প্রকারের হয়ে থাকে : এক. যে নিজের ইরতিদাদের ঘোষণা দিয়েছে। দুই. যে ইরতিদাদ-মূলক কোনো আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে অথবা অনুরূপ কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত থেকেও নিজেকে কথা বা কাজে মুসলমান বলে দাবী করছে। দ্বিতীয় প্রকারের মুরতাদকে যিন্দীক, মুলহিদ ও মুনাফিক ইত্যাদি বলা হয়।

স্বঘোষিত মুরতাদ হোক আর মুনাফিকজাতীয় মুরতাদ হোক, উভয় প্রকার মুরতাদের ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম হল, যদি আদালতে এদের ইরতিদাদ প্রমাণ হয়ে যায়, তাহলে তার বিষয়ে শরীয়ত মোতাবেক ফয়সলা করা বিচারকের উপর ফরজ। আর প্রশাসনের ফরজ হল ঐ শাস্তি অপরাধীর উপর প্রয়োগ করা।

আল্লাহ পাকের আইনে মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি কী- সেটা ইসলামী শরীয়তের অকাট্য সর্বজনস্বীকৃত ও যুগ পরম্পরায় অনুসৃত শিক্ষাগুলির একটি। এর উপর উম্মতের সকল মাযহাব, সকল গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর ইজমা রয়েছে। এতে কোনো কালেই কোনো আলেমে দ্বীনের দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে থাকলে মুলহিদ-যিন্দীকরাই করেছে। কোনো মুমিন করেনি। একজন মুমিন তো শরীয়তের সকল বিধানের উপর ঈমান রাখে। হদ-কিসাস ও দন্ডবিধি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এগুলিকে হুবহু মেনে নেওয়াই ঈমান। এগুলির একটি হল, মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

বিচারকের জন্য নিয়ম হল, মুরতাদকে প্রথমে তওবা করার সুযোগ দিবে। তওবা করলে তো ভালো। অন্যথায় নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করবে।

মুরতাদের তওবা কবুল করা এবং এ উসিলায় তার শাস্তি মওকুফ করা শরীয়তে মুহাম্মদীর বিধান। নতুবা তাওরাতের শরীয়তে তওবা করলেও এ শাস্তি মাফ হত না। বরং তওবার মাধ্যমে পরকালীন শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দুনিয়াবী শাস্তি গ্রহণ করা অপরিহার্য ছিল।

বনী ইসরাইলের একটি দল যখন গোবৎসের পুজা করে শিরকে লিপ্ত হল, যে কারণে তারা মুরতাদ হয়ে গেল, তখন তাদের ব্যাপারে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হল এবং এটা তাদের তওবারই একটা অংশ ছিলো। ইরশাদ হয়েছে-

(তরজমা) ‘যারা বাছুরকে উপাস্য বানিয়েছে, শীঘ্রই তাদের রবের গজব তাদেরকে পাকড়াও করবে আর দুনিয়ার জীবনেই লাঞ্ছনা আপতিত হবে। যারা মিথ্যা রচনা করে, আমি এভাবেই তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।’ (আরাফ ৭ : ১৫২)

মুরতাদের উপর আপতিত সেই গজব ও লাঞ্ছনা কী ছিল? কোরআনেই ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّكُمْ ظَلَمْتُمْ أَنْفُسَكُمْ بِاتِّخَاذِكُمُ الْعِجْلَ فَتُوبُوا إِلَى بَارِئِكُمْ فَاقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ عِنْدَ بَارِئِكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

তোমরা বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করেছ। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট তওবা কর এবং নিজেরা নিজেদের মাঝে মৃত্যুদন্ড কার্যকর কর। তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট এ ব্যবস্থা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তাহলে তিনি তোমাদের তওবা কবুল করবেন। তিনি তো তওবা কবুলকারী, পরম করুণাময়। (বাকারা ২ : ৫৪)

দুনিয়াতে এই ক্রোধ ও গজব এবং লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা যারা শিরক করে মুরতাদ হয়ে গেছে শুধু তাদের জন্যই নয়, বরং সব ধরনের মুরতাদের জন্য। ইরশাদ হয়েছে-

(তরজমা) যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর তার কুফরীতে লিপ্ত হয় -অবশ্য সে নয়, যাকে কুফুরীর জন্য বাধ্য করা হয়েছে, কিন্তু তার অন্তর ঈমানের উপর প্রশান্ত রয়েছে, বরং সেই ব্যক্তি, যে সহৃদয়ে কুফুরী মেনে নিয়েছে, এরূপ ব্যক্তির উপর আল্লাহর গজব এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (নাহল ১৬ : ১০৬)

সূরা বাকারার ৫৪ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায়, মুরতাদের উপর আপতিত খোদায়ী গজব হল মৃত্যুদন্ড। ইসলামের প্রতি দুশমনি করা অথবা যে কোনো ধরনের শিরকী-কুফরী কর্ম ও বিশ্বাসের মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে যাওয়া ব্যক্তি -যদিও সে আচরণে-উচ্চারণে নিজেকে মুসলমান প্রমাণের চেষ্টা করে -তবু সে মুরতাদ। কোরআনের পরিভাষায় এমন ব্যক্তিকে ‘মুনাফিক’ বলা হয়। এদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন-

لَئِنْ لَمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْمُرْجِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا  مَلْعُونِينَ أَيْنَمَا ثُقِفُوا أُخِذُوا وَقُتِّلُوا تَقْتِيلًا  سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا

মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা এবং মদীনাতে ভয়ংকর সংবাদ রটনাকারীরা যদি নিবৃত্ত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমি আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রবল করে দিব। আর তখন তারা আপনার প্রতিবেশী হিসাবে সেখানে বেশি দিন টিকতে পারবে না। তাও থাকবে অভিশপ্ত অবস্থায়, যেখানেই এমন লোককে পাওয়া যাবে, ধরে ধরে একে একে হত্যা করে ফেলা হবে। আল্লাহ তাআলার এ নিয়ম পূর্ববর্তী লোকদের জন্যও বলবৎ ছিল। আল্লাহর নিয়মে কোনো দিন আপনি কোনো ব্যত্যয় খুজে পাবেন না। (আহযাব ৩৩ : ৬০-৬২)

‘উল্লেখিত আয়াতে মুরতাদ-মুনাফিকের দুটি অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা থেকে বিরত না হলে শাস্তি লাঞ্ছনা এবং মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আয়াতের শেষ অংশ থেকে এ-কথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পূর্ববর্তী নবীগণের শরীয়তেও মুরতাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড।’ (মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী ৭ : ২৩৪-২৩৫)

About the author